অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যা

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - সত্তরের নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধ | NCTB BOOK
522

২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ জুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল । ‘অপারেশন সার্চলাইট' নামে ঢাকায় যে গণহত্যা শুরু করে, এর প্রধান লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এদেশের ছাত্রসমাজ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী আর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় । কারণ, পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বিশ্বাস করত, পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন-সংগ্রামের পেছনে হিন্দুদের হাত রয়েছে, আর এদের ইন্ধন যোগায় ভারত ।

যদিও ২৫শে মার্চ ‘জিরো আওয়ারে' পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু করার কথা, তথাপি রাত সাড়ে এগারোটার দিকে সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যায় পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যে। ঢাকাসহ সারা দেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক অভিযান শুরু করে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল এবং বহু শিক্ষকের আবাসিক ভবনে তারা আক্রমণ করে অনেককে হত্যা করে । রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে, পিলখানার ইপিআর হেডকোয়াটার্সসহ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ট্যাংক, কামান, মেশিনগান দিয়ে হামলা চালায়। শুরু হয় ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ জনতা ঢাকার রাজপথে ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা করে । অসীম সাহস নিয়ে ইপিআর ও পুলিশ বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলে । কিন্তু আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী অনায়াসে ভেঙে ফেলে এই প্রতিরোধ ।

পুরনো ঢাকার নবাবপুর, তাঁতিবাজার, শাঁখারীবাজার এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষোভ যে বেশি ছিল তা সেখানকার নিষ্ঠুর গণহত্যা, নির্যাতন আর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বোঝা যায়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে হিন্দুমাত্রই আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং হিন্দুরা হচ্ছে ‘পবিত্র’ পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি হুমকিস্বরূপ । আর এদের পেছনে রয়েছে ভারতের আনুকূল্য ও সমর্থন । এমনি অন্ধবিশ্বাস থেকে গণহত্যা আর নারী নির্যাতনের ভিতর দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র হিন্দু বিদ্বেষ, আক্রোশ আর ভয়ংকর ঘৃণার প্রকাশ ঘটে । আকস্মিক আক্রমণে নিরীহ, অসহায় নগরবাসী আত্মরক্ষার কোনো সুযোগই পায়নি ।

সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর রোষানলে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্ৰ দেব, ড. মুনীরুজ্জামানসহ অনেক শিক্ষক এবং শত শত ছাত্রকে হত্যা করা হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা দুই দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে মারা যান । পুরনো ঢাকায় বিশেষ করে শাঁখারীবাজার, তাঁতি বাজারের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার অবস্থা ছিল ভয়াবহ । ঢাকাবাসী দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তাদের জন্য কী বর্বর, নৃশংস, পৈশাচিক আক্রমণ অপেক্ষা করছে। ঢাকা শহর পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। চারদিকে কেবল আর্তনাদ, অসহায় মানুষের হাহাকার আর লাশ ।

কেবল রাজধানী ঢাকা শহর নয়, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে যায় পাকিস্তানি বাহিনী । মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। দুই লাখের অধিক মা-বোন পাকিস্তানিদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল । পরিকল্পিতভাবে এদেশকে মেধাশূন্য করার জন্য তারা বরেণ্য সাহিত্যিক, শিল্পী, কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীকে নির্মমভাবে হত্যা করে ।

Content added By
Promotion
NEW SATT AI এখন আপনাকে সাহায্য করতে পারে।

Are you sure to start over?

Loading...